মেঘ

মেঘ
মেঘ, সুনিদ্রা ও নন্দলালের পঙ্গপাল

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

টিউমারের জীবন, জীবনের টিউমার

দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাটাই যে কখনো কখনো কত সৌভাগ্যের হতে পারে তা জানতে অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) এ যুগে আমাদের ঘড় ছেড়েও বেরুতে হয় না। হাতের মোবাইল বা টেবিলের উপর থাকা ডেস্কটপ বা কোলের ল্যাপটপেই আমরা দুনিয়া তন্ন তন্ন করে এমন হাজারো গল্প পেয়ে যেতে পারি।

২০ মার্চ এমন এক গল্পই বিশ্ববাসীর সামনে এনেছে ডেইলি মেইল অনলাইন। India's elephant man: Heartbreaking struggle of recluse, 34, who lives in agony with a nine pound face TUMOUR that looks more like a trunk’ শীর্ষক লেখাটাই এখানে অনুবাদের চেষ্টা করছি।


ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ-এর প্রত্যন্ত এক গ্রামে বাস চাঁন লালের। বয়স ৩৫। আয়নাতে নিজেকে দেখতে ভয় পাওয়া এই মানুষটি থাকেন সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়েই, প্রায় একা।


চাঁন লাল ঠিকমতো খেতে বা কথা বলতে পারেন না। আর এর কারণ হলো তার মুখে থাকা একটি টিউমার। তবে মুখে থাকা একটি টিউমার- কথাটি এভাবে বললে লালের অবস্থাটা আসলে ঠিকঠাক বলা হয় না। লালের মুখের এই টিউমারটির ওজন নয় পাউন্ড। টিউমারটির জন্ম মুখে হলেও তা নেমে এসেছে চাঁন লালের বুক অব্দি।

অপারেশন করে নয় পাউন্ড ওজনের এই টিউমারটি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ক্রমাগত যন্ত্রণায় ভুগছেন চাঁন লাল। তার এই যন্ত্রণার সাক্ষী কেবল তারই দুই ভাগ্নী।

চাঁন লাল আসলে ভুগছেন নিউরোফিবরোমেটোসিসে। সর্বশেষ ১০ বছর আগে তিনি একবার অপারেশনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ অপারেশনের চেষ্টা তাকে মৃত্যুর এত কাছে নিয়ে গিয়েছিল যে চিকিৎসরা তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, বাঁচতে চাইলে ভবিষ্যতে তিনি যেন এ চেষ্টা আর কখনো না করেন।

আর সেই থেকে এভাবেই বেঁচে আছেন চাঁন লাল।

আট ভাই-বোনের মধ্যে লাল সবার ছোট। নিঃসঙ্গ জীবনে এখন তিনি বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রাত্যহিক কাজে তাকে সাহায্য করেন তার দুই ভাগ্নী।





চাঁন লাল বলেছেন, ‘আমার চেহারাটা কুৎসিত; আমি নিজেও আয়নাতে নিজেকে দেখতে পছন্দ করি না আর তাই অন্য কেউ আমার দিকে তাকাবে- এমন আশাও আমি করি না।’

‘অপারেশন হলে ভালো হতো কিন্তু আমি সব আশা ছেড়ে দিয়েছি। শেষবার যখন অপারেশন করতে গিয়েছিলাম তখন আমি প্রায় মারাই গিয়েছিলাম তাই এখন সন্দেহ হয় এই মুখে আর কিছু করা যাবে কী না।’

যে গ্রামে লালের বাস সে গ্রামেই সামান্য শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম হয়েছিল তার। কিন্তু দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান আর ধারেকাছে কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতাল না থাকায় আট বছরের আগে তার চিকিৎসা শুরু হয়নি।

চাঁন লালের ভাষায়, ‘আমি জানতাম আমার চেহারায় অদ্ভুত কিছু একটা আছে যার জন্য বাচ্চারা আমাকে দেখে পালায়।’

‘আমার মনে আছে, আমি মায়ের কাছে কাঁদতাম আর মা আমাকে সরাসরি বলেছিলেন আমার চেহারাটা ভয়ঙ্কর। এরপর আমি আর কোনোদিন কাউকে আমার সঙ্গে খেলতে বলিনি।’

ওইবছরই লালের বাবা-মা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসার জন্য ১৫ হাজার রুপি ফি খুব বেশি হওয়ার কারণে তারা বাড়িতে ফিরে আসেন।

ভ্রাম্যমান একটি সার্কাস দল লালের বাবা-মাকে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, তাকে প্রদর্শন করতে দিলে তারা কিছু টাকা দেবে। তবে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান হয়ে যায়।

এরপর তার বয়স যখন ২৫ বছর তখন লালের পরিবার পর্যাপ্ত অর্থ যোগাড় করতে সমর্থ হয় এবং অপারেশনের জন্য তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়।




অপারেশনে চিকিৎসকরা তার মূল একটি ধমনী কেটে ফেললে অনিয়ন্ত্রিতভাবে রক্তপাত শুরু হয়।

লাল বলেছেন, চিকিৎসকরা তার বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তারা যদি লালকে বাঁচিয়ে রাখতে চান তবে তার আর কখনো কোনো অপারেশন করানো উচিৎ হবে না।

টিউমারটি এখন এতটাই বড় হয়েছে যে, লাল এখন বাম চোখে কিছুই দেখছেন না এবং বাম কানে কিছু শুনতে পান না।

তিনি বলছেন, ‘আমি চিবাতে পর্যন্ত পারি না। কারণ, আমার চোয়াল পড়ে গেছে। দাঁতগুলো কোনো কাজ করতে পারে না। আমার এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে রসালো একটা আপেলে কামড় দিতে কেমন লাগে।’

মাঝেমধ্যে যদিও নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবনে শ্রমিকের কাজ তিনি করেন কিন্তু এগুলো অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

‘আমি নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে আছি। ভারি কিছু টানতে গেলে আমার মাথায় ব্যাথা লাগে কিন্তু আমি অভিযোগ করি না; আমার মনিব যদি আমার গোঙ্গানি শোনেন তবে আমাকে কাজ দেবেন না।’

লালের ভাগ্নী সুমন ভার্মা তার দেখাশোন করেন। সুমন তার মামায় বিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি যখন একা বসে তার কথা ভাবি আমার খুব খারাপ লাগে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার অন্য মামা-চাচাদের মতো তারও স্বাভাবিক একটা জীবন আমি চাই। যখন ছোট ছিলাম আমি তাকে দেখে ভয় পেতাম কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তিনি খুব নরম একজন মানুষ। আমি কখনো তাকে রাগতে দেখিনি।’



‘আমরা তার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাকে দেখার পর মেয়ের পরিবারের লোকজন চলে যায়। আমি চাই কোনো একজন নারী তাকে ভালোবাসুক, সে যেমন সে অবস্থাতেই।’

লাল নিজেও বিয়ে করতে চান এবং সন্তানের বাবা হতে চান। কিন্তু আশাহত এই মানুষটি বলছেন, ‘মেয়েদের বাবারা ভাবেন আমার সঙ্গে বিয়ে হলে তাদের মেয়েরাও আমার রোগে আক্রান্ত হবেন।’

‘তারা ভাবেন এটা ছোঁয়াচে আর সে কারণে ভয় পেয়ে তারা পালিয়ে যাবেন।’

লাল যখন তার গ্রামের বাইরে যান লোকজন তাকে দেখে অবাক হয়ে যান। তারা টিউমারে আক্রান্ত চাঁন লালের মুখের সঙ্গে হিন্দু দেবতা গনেশের কিছু একটা মিল খুঁজে পান।

লাল বলছেন, ‘লোকেরা আমার পা ছুঁয়ে তাদের আশীর্বাদ করতে বলেন। কারণ, আমার চেহারা নাকি একজন দেবতার মতো। কিন্তু এতে আমার রাগ হয়। আমি অবশ্যই কোনো দেবতা নই। আমি কোনো দেবতা হলে আমাকে এত কষ্ট সইতে হতো না।’

‘এই কুৎসিত চেহারা থেকে আমি মুক্তি চায়। কোনো চিকিৎসক যদি বলেন তারা কিছু করতে পারবেন আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি সবকিছুর চেষ্টা করবো।’

লক্ষ্ণৌ -এর হেমকান্ত প্রাইভেট নার্সিং হোমের জেনারেল সার্জন ডা. ভিনায়েক মিশরা (৩৪) বললেন, ‘এটা নিউরোফিবরোমেটোসিস টাইপ ১। এই টিউমারটি তার মুখের আকৃতি সম্পূর্ণরুপে নষ্ট করে দিয়েছে।’

‘এই রোগ যদি আরও বাড়তে থাকে তবে তার আলসিরেশনস ও ইনফেকশাস সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ কারণে হয়তো তার মৃত্যু হবে না তবে শরীরে এতব্ড় একটা টিউমার বয়ে বেড়ানোর ফলে হয়তো টিউমারটি তাকে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছেই নিয়ে যাবে।’

মূল: ডেইলি মেইল                      

   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন